ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ (নাথেরপেটুয়া, মনোহরগঞ্জ, কুমিল্লা) এর স্থায়ী ভবনের শুভ উদ্বোধন উপলক্ষে অসহায় শীতার্ত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। গত শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি ২০২৫) সকাল ১০টায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে এ অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদের সহ-সভাপতি অধ্যাপক সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন পর আমাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারায় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। আমাদের এই আয়োজনে সবাইকে উপস্থিত হওয়ার জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন তাহমিনা আক্তার, উপজেলা সমাজসেবা অফিসার, মনোহরগঞ্জ, কুমিল্লা। তিনি বলেন, “সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য এমন সামাজিক কার্যক্রমের প্রয়োজন। দীর্ঘ সময় ধরে পরিষদের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে তাদের পুনরায় নিবন্ধনের ব্যবস্থা করেছি। ভবিষ্যতে এলাকার সকল মানুষকে নিয়ে এ ধরনের সামাজিক কাজে আমরা একসাথে কাজ করব।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন জনাব আবুল হোসেন চৌধুরী, সভাপতি, ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ এবং দৈনিক সংগ্রামের জেনারেল ম্যানেজার। তিনি বলেন, “সমাজ পরিবর্তনের এই কাজ থেকে আমাদেরকে দীর্ঘদিন দূরে রাখা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, সামাজিক কাজের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। আজকের এই কার্যক্রম সেই পরিবর্তনেরই একটি ধাপ। আমি এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানাই এবং আশা করি আপনারা আমাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমেও পাশে থাকবেন।
তিনি আরও বলেন, ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ সবসময় অসহায় ও দুঃস্থ মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করে। আমাদের এই স্থায়ী ভবন উদ্বোধন শুধু একটি ভবন নির্মাণ নয়, এটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। আমরা চাই সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও কল্যাণমুখী সমাজ গড়ে তুলতে।
সভাপতি তার বক্তব্যে আরও উল্লেখ করেন, একটি সুসংগঠিত এবং মানবিক সমাজ গঠনের জন্য দরকার সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ঐক্য। আমরা যারা এখানে উপস্থিত রয়েছি, তাদের সবাই মিলে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। সমাজের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের উন্নতির জন্য কাজ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ইনশাল্লাহ, ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ এই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাবে।
অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সমাজসেবক, শিক্ষাবিদ এবং রাজনীতিবিদ হাফেজ মাওলানা নুরুন্নবী। তিনি বলেন, মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবজাতির জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই জীবনব্যবস্থার মূল ভিত্তি ছিল সামাজিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, সমাজে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া শান্তি ও কল্যাণ সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন, ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)। এই আয়াত সমাজে ঐক্য ও সংহতির গুরুত্ব সুস্পষ্ট করে তোলে।
তিনি আরও বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার সমাজে মুসলিম, ইহুদি ও মুশরিকদের মধ্যে যে চুক্তি করেছিলেন, সেটি সামাজিক ঐক্যের এক অনন্য উদাহরণ। তিনি সব সময় মানুষকে একতাবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বিভেদ পরিহারের পরামর্শ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুমিনগণ পরস্পর এক দেহের মতো; যদি দেহের একটি অঙ্গ কষ্ট পায়, তবে পুরো দেহ তার জন্য উদ্বিগ্ন হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)। এই শিক্ষা আমাদের সমাজে ঐক্য ও সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠার প্রেরণা দেয়।
প্রধান বক্তা তার আলোচনায় বলেন, সামাজিক বিপ্লবের জন্য ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজ—এই তিনটি স্তরে পরিবর্তন আনতে হবে। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।’ (সূরা আর-রাদ: ১১)। এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, সমাজের পরিবর্তন শুরু হয় ব্যক্তি থেকে। তাই আমাদের প্রত্যেককে নিজের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি যদি ইসলামের নীতি ও মূল্যবোধ মেনে চলে, তবে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সে, যে তার ভাইয়ের উপকারে আসে।’ (বুখারি ও মুসলিম)। এই হাদিস আমাদের শিখায় যে, একে অপরের উপকার করা এবং দুঃস্থদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জনাব মাওলানা ফয়জুর রহমান, বিশিষ্ট সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ। তিনি বলেন, “সামাজিক উন্নয়নের জন্য ইসলামী মূল্যবোধ চর্চা করা অত্যন্ত জরুরি। ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদের আজকের এই উদ্যোগ আমাদের সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বক্তব্য রাখেন মোঃ আলী আহমদ, প্যানেল চেয়ারম্যান, ১০ নং ইউনিয়ন। তিনি বলেন, “স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক কাজগুলোতে আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগ এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মাওলানা আব্দুল গফরান, সহ-সভাপতি, ইসলামিক সমাজ কল্যাণ পরিষদ এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ, বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক কার্যক্রম থেকে দূরে ছিলাম। তবে আজকের এই উদ্যোগ প্রমাণ করে যে, আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
মাওলানা মোশাররফ হোসেন, সেক্রেটারি জেনারেল, ইসলামিক সমাজ কল্যাণ পরিষদ, বলেন, এই ভবন উদ্বোধন এবং শীতবস্ত্র বিতরণ কর্মসূচি আমাদের নতুন যাত্রার সূচনা বৃত্তবানরা পাশে থাকলে আমরা অনেক দুর এগোতে পারব ইনশাআল্লাহ। এটি আমাদের সমাজের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে।
নাথেরপেটুয়া ফাঁড়ি থানার ইনচার্জ নিরব হোসেন বলেন, সামাজিক উন্নয়নের জন্য আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। অতীতের বিভিন্ন বাধা সত্ত্বেও আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
বক্তব্য রাখেন জাফর ইকবাল রাশেদ, সহ-সেক্রেটারি, ইসলামিক সমাজ কল্যাণ পরিষদ। তিনি বলেন, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই মহৎ উদ্যোগ আমাদের তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।
সাংবাদিক মোঃ আবদুর রহমান, সমাজসেবা সম্পাদক, ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ, বলেন, “সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানে মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এই উদ্যোগের খবর ছড়িয়ে দিয়ে অন্যদেরও সামাজিক কাজে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করব। দীর্ঘ ১৬ বছর আমাদের সমাজ কল্যাণের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা আজ নতুন স্থায়ী ভবনের নির্মাণ সম্পন্ন করতে পেরেছি। এর জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ভবিষ্যতে আমাদের সকল কর্মসূচি ও সামাজিক কাজগুলো একযোগে সবার সহযোগিতায় এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
রবিউল ইসলাম, তরুণ ছাত্র নেতা, বলেন, তরুণ সমাজই দেশের ভবিষ্যৎ। আজকের এই উদ্যোগ আমাদের তরুণদের আরও সামাজিক কাজের প্রতি উৎসাহিত করবে।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদের নির্বাহী সদস্য জনাব আবু ইউসুফ, আবু বকর, জনাব আনোয়ার হোসাইন, পরিষদের সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোবারক হোসাইন, মোরশেদ, মোঃ মহিবুল্লা, রোকন উদ্দিন, ইয়াসিন, ছাত্রনেতা জুনায়েদ, ইব্রাহিম, ইমরান প্রমুখ। এছাড়াও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবীগণ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে প্রায় দুই শতাধিক অসহায় শীতার্ত মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র উপহার বিতরণ করা হয়, যা উপস্থিত সবার মধ্যে মানবিক চেতনার সঞ্চার করে এবং এলাকার সামাজিক কার্যক্রমে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।