কয়েক বছর আগেই ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন উপজেলার মাঠে হেমন্তের হাওয়ায় ভেসে বেড়াত ধানের সুগন্ধিযুক্ত ঘ্রাণ। গ্রামের মানুষ সেই সুগন্ধের সাথে তাল মিলিয়ে হাসি আর আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতেন। গ্রামের পথঘাটে মিশে থাকত কৃষকের হাসি ও ফসলের আনন্দ।ঠাকুরগাঁওয়ের সেই মাঠে ফুটত ২৭ প্রজাতির আদি ধান—মাল সারা, আষামী, কালমোটা, মাগুরশাল, সাপাহার, রাজু ভোগ, কালো নেনিয়া, সাদা নেনিয়া, সিন্দুর কটুয়া, ধোরা ভাদুই, চেঙ্গা, কাকুয়া, পারি যা, কাশিয়া বিন্নি, কল মিতা—যা শুধু খাদ্য হিসেবে নয়, ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষের সংস্কৃতির ঐতিহ্যের অঙ্গ।
কিন্তু আজ সেই সব ধানের বদলে সোনালি মাঠ ভেরে গেছে হাইব্রিড ধানের জাতে।উচ্চ ফলনশীল হওয়ায় হাইব্রিড ধানের জাতের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে আদি ধানের সুগন্ধি স্বাদ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সংরক্ষণাগারে রাখা বীজগুলো নীরবে জানাচ্ছে সেই হারানো সময়ের গল্প। একসময় এই মাঠগুলোতে ছিল আদি ধানের দাপুটে আধিপত্য কিন্ত আজ তা বিলুপ্তপ্রায়।
হরিপুর উপজেলার আমগাঁর কৃষক আমিনুল হক জানান, আগের ধানের ভাত মুখে যেন লেগে থাকত কি মিষ্টি ঘ্রাণ। এখন আর তা নেই। পিঠাপুলি, পায়েস সব কিছুতেই যেন অন্যরকম স্বাদ মুখে লেগেই থাকতো।
আষামী ধানের স্মৃতিচারণ করে যাদুরানীর কৃষক আলমগীর জানান, ধান মাড়াইয়ের সময় তার সুগন্ধে পুরো পরিবেশ ভরে যেত এবং তারা মুগ্ধ হয়ে পড়তেন।
স্থানীয় চাল ব্যবসায়ী শফিক বলেন, নতুন ধানের চাল খেলে পেট ভরে কিন্তু মন তৃপ্ত হয় না। এই ধানগুলো আমাদের স্মৃতি, আমাদের সংস্কৃতির অংশ।
কামারপুকুরের আলিম বলেন, “আমাদের জীবন এই ধানের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আজ তা হারিয়ে যাচ্ছে, কেবল বীজ সংরক্ষণাগারে রয়ে গেছে। এখন মানুষ এসব ধান উৎপাদনে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
স্থানীয়রা বলছেন, একসময় ঠাকুরগাঁওয়ে বছরে দুই মৌসুমে আদি ধান চাষ হতো। হেমন্তে ঘরে ওঠত নানা রঙের ধান, যা আশ্বিন-কার্তিক মাসের খাদ্য ও উৎসবকে সমৃদ্ধ করত। আজকাল কৃষকরা বছরে তিন মৌসুমে হাইব্রিড ধান চাষ করছেন। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে হারিয়ে গেছে ধানের সঙ্গে জড়িত মানুষের গল্প, স্মৃতি ও সংস্কৃতি।
মোজাহেদুর ইসলাম ইমন বলেন, “দেশি ধান কেবল খাদ্য নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র্যের অংশ। কৃষকরা এখন হাইব্রিড চাষে ঝুঁকছেন তাৎক্ষণিক লাভের জন্য। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। প্রায় ২৭টি আদি জাত বিলুপ্ত হয়ে গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর সেই ধানের স্বাদ বা জেনেটিক সম্পদ উপভোগ করতে পারবে না। এটি শুধু কৃষির নয়, পরিবেশের জন্যও হুমকি।
আদি ধান সংরক্ষণের জন্য সরকারের পদক্ষেপ প্রয়োজন মোজাহেদুর ইসলাম ইমন এ কথা জানান। সংরক্ষণাগার তৈরি করা, কৃষককে দেশি ধান চাষে উৎসাহিত করা এবং ভোক্তাদের সচেতন করা। নইলে একদিন হয়তো ইতিহাসের পাতায় আমরা পড়ব যে, একসময় বাংলাদেশে শত শত আদি ধানের জাত ছিল।”