২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ছিল বাংলাদেশে একটি স্মরণীয় দিন, যা রাজনৈতিক সংঘর্ষের জন্য এখনও আলোচিত। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিন, এই সময়ে দেশের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট তুমুল আন্দোলন করছিল। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে বাধা দেওয়া।
সেদিন ঢাকার পল্টন এবং বায়তুল মোকাররম এলাকায় জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ ঘটে। রাস্তার ওপর প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন, গুলি চালানো, এবং মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনার মাধ্যমে পুরো দেশ জুড়ে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ২৮ অক্টোবরের সেই রক্তক্ষয়ী দিনটি রাজনৈতিক সহিংসতার এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
সেদিনের সহিংসতার পেছনে মূলত আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলীয় জোটের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিয়ে আপত্তি ছিল। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিনে, বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচি এবং অবরোধের কারণে সংঘাত ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন এবং সংঘর্ষ চলতে থাকে।
তিন দিনের তুমুল সংঘর্ষের পর, আওয়ামী লীগ কার্যত রাজপথ দখল করে নিতে সক্ষম হয়। ২৮ অক্টোবরের আগের দিন এবং পরের দিনও দেশের বিভিন্ন স্থানে রক্তক্ষয়ী সংঘাত ঘটে, যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর ক্ষত হিসেবে বিবেচিত হয়। আওয়ামী লীগের শক্তিশালী উপস্থিতি এবং সমর্থকদের সক্রিয় ভূমিকা তাদের রাজপথে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।
২৮ অক্টোবর ২০০৬ সালের এই দিনে ঢাকার পল্টন মোড়ে সংঘটিত হয় রাজনৈতিক সহিংসতা, যেখানে লগি-বৈঠার তাণ্ডবে প্রাণ হারান ১৩ জন। এর মধ্যে ৬ জন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী এবং একজন ছাত্রমৈত্রীর সদস্য ছিলেন। রাজধানীর পল্টন এলাকায় হাজারো মানুষের সামনে প্রকাশ্যে এই সহিংসতা ঘটে। লাশের ওপর উন্মত্ত নৃত্যের দৃশ্য দেখে দেশ ও বিদেশের মানুষ হতবাক হয়ে যায়।
এই সহিংস ঘটনার পর পল্টন ও শাহবাগ থানায় ৫টি মামলা করা হয়। আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় আসার পর প্রত্যাহার করা হয়। তবে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো উচ্চ আদালত স্থগিত করে রেখেছেন।
২৮ অক্টোবরের ঘটনার মূল কেন্দ্র ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের আহূত অবরোধ কর্মসূচি। জামায়াত-শিবিরের নিহত কর্মীদের মধ্যে ছিলেন মোজাহিদুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন (১), জসিম উদ্দিন (২), গোলাম কিবরিয়া শিপন, ফয়সাল এবং হাবিবুর রহমান। পরবর্তীতে আহত সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুমও হাসপাতালে মারা যান। অন্যদিকে ছাত্রমৈত্রীর খিলগাঁও থানা সাধারণ সম্পাদক রাসেল খানও নিহত হন। সহিংসতায় আহত হন আরও প্রায় এক হাজার মানুষ।
জামায়াতে ইসলামী পল্টন থানায় মামলা দায়ের করে, যেখানে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিমসহ ৪০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। পাল্টা মামলা দায়ের করা হয় ছাত্রমৈত্রীর পক্ষ থেকে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে।
২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠার তাণ্ডবের স্মৃতি আজও মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে। সহিংসতার শিকার পরিবারগুলোর জন্য সেই দিনের ঘটনা একটি দুঃস্বপ্ন, যা রাজনীতির অন্ধকার দিকের সাক্ষ্য বহন করে। আইন আদালতের প্রক্রিয়ায় কিছু মামলার সমাপ্তি ঘটলেও, অনেকের কাছে সেদিনের নৃশংসতার বিচার আজও অনিশ্চিত রয়ে গেছে।