আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বাংলাদেশ সরকারের প্রতি গণগ্রেপ্তার, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং বলপূর্বক গুম বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বিলুপ্তির সুপারিশসহ বিভিন্ন কাঠামোগত সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে।
গত মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) মানবাধিকার সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এলাইন পিয়ারসনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এ সময় তারা "আফটার দ্য মুনসুন রেভল্যুশন: আ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ" শীর্ষক ৫০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন হস্তান্তর করে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশি একনায়ক শেখ হাসিনা সরাসরি গুম ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সংস্থাটির মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার ও তদন্তে উঠে এসেছে যে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতারা গুম ও হত্যার বিষয়ে অবগত ছিলেন এবং কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এলেইন পিয়ারসন বলেন, ২০০৯-২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনী রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ছিল এবং তারা শাসক দলের ক্যাডারের মতো আচরণ করত। তাই এখনই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সময়।
এইচআরডব্লিউ র্যাবকে বিলুপ্তির আহ্বান জানিয়ে বলেছে, বাহিনীটির সদস্যরা অন্য কোথাও গিয়ে একই ধরনের অপরাধ না করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে এ বাহিনী যেন কোনো সরকারের রাজনৈতিক দমন-পীড়নের হাতিয়ার না হয়, সেটাও নিশ্চিত করা জরুরি।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এ বিষয়ে বলেন, র্যাব তাদের অপরাধের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে, তবে বিচারের আওতায় এনে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়নের জন্য দ্রুত কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে: ক্ষমতার পৃথকীকরণ: জনপ্রশাসন, পুলিশ, সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। গণগ্রেপ্তার বন্ধ: পুলিশের জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করা, যাতে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা এবং নির্বিচারে গ্রেপ্তার বন্ধ করা যায়। বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত: আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করা। আইন সংশোধন: সমালোচকদের দমনে ব্যবহৃত বিদ্যমান আইনের সংশোধন নিশ্চিত করা। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা: সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের নেতাদের হয়রানি বন্ধ করা এবং বাকস্বাধীনতা রক্ষা করা।
এইচআরডব্লিউ সুপারিশ করেছে যে, অন্তর্বর্তী সরকারকে মার্চ মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশনে একটি ঐকমত্যের প্রস্তাব আনতে হবে। এতে করে সংস্কার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার জন্য জাতিসংঘের অব্যাহত পর্যবেক্ষণ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নত করতে এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিতে পারে। সংস্থাটি বলেছে, "গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হলে শুধুমাত্র নতুন সরকার পরিবর্তন করলেই হবে না, বরং শক্তিশালী ও কার্যকর সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।" বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে এই সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন করে, তা দেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।