অনাবিষ্কৃত সত্য নিয়ে কাজ করে বলে বোধ হয় পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। কয়েক দিন আগেও আমার একজন মেন্টর বললেন, ‘বুঝলি, ইউনিভার্সিটিটা ঠকিয়েছে।’ একাধিক গবেষণায় উঠেও এসেছে যে গ্র্যাজুয়েটরা মনে করছেন না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাঁদের জীবনে খুব অবদান রাখতে পেরেছে।
বাংলাদেশ তার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কী ভাবছে? কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ১৯৭৪ থেকে শুরু করে শিক্ষানীতি ২০১০ পর্যন্ত নীতিগতভাবে জ্ঞান অনুসন্ধানের সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি উৎপাদন আমাদের উচ্চশিক্ষার মূল অভিমুখ। তবে নীতির সঙ্গে বাস্তবতার মিল অল্পই। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা হয় নামমাত্র।
ছাত্ররা ব্যস্ত কর্মসংস্থানের চিন্তায়। বিশ্বজুড়ে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনাই মানুষের রুটিরুজির জন্য যথেষ্ট হওয়ার কথা। কিন্তু এ দেশে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়লে আয়রোজগারের কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। ফলে সবাই ছুটছে অনার্স, মাস্টার্স, পিএইচডি করতে। পাশের দেশেই দেখা গেছে করণিক পদে কয়েক হাজার ডক্টরেট আবেদন করেছেন। আমাদেরও সে অবস্থায় যেতে বেশি দেরি নেই। কোনো মৌলিক উদ্দেশ্যের সাপেক্ষেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে না।
কিন্তু কেন? উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা যে জ্ঞান-দক্ষতা-অভিজ্ঞতা দেওয়ার কথা, তা দিতে পারছে না বলেই উচ্চশিক্ষার ওপর এত চাপ? নাকি কর্মসংস্থান এত উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন হয়ে গেছে, যা উচ্চশিক্ষাও সরবরাহ করতে পারছে না?
আমাদের স্কুলব্যবস্থা বস্তুত ব্যর্থ। ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাথমিক পর্যায়ের পরেও বাংলা পড়ে বুঝতে বা যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করতে পারে না। উচ্চমাধ্যমিক পাস করা ১০ শতাংশ পরীক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার পাস নম্বর তুলতে হিমশিম খায়। তাহলে শিক্ষার স্তর অনুযায়ী যে যোগ্যতা অর্জিত হওয়ার কথা, তা হচ্ছে না বলেই কি উচ্চশিক্ষার ওপর সব দায় বর্তাচ্ছে। এই ব্যর্থতার পেছনে কি সক্ষমতার অভাব, সদিচ্ছার অভাব, নাকি তা ইচ্ছাকৃত?
সক্ষমতা বা সদিচ্ছার অভাব থাকলে তা নিবারণের উপায় আছে। কিন্তু তা ইচ্ছাকৃত হলে তো রীতিমতো ভয়াবহ শাস্তিযোগ্য অপরাধের পর্যায়ে চলে গেছে। এটা খতিয়ে দেখা দরকার। ২০১০ থেকে ২০২০-এর মাঝে এক দশকে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটে। ২০২১ থেকেই বোঝা যেতে থাকে যে শিক্ষিত বেকার বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। সরকারি কোনো নীতিমালায় গ্র্যাজুয়েটদের গন্তব্য নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়নি! তাহলে এত বিশ্ববিদ্যালয় কেন?
সোজা কথায়, সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে কালক্ষেপণ। কর্মসংস্থান তৈরি করতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা। নব্য উদারবাদী নীতি গ্রহণকারী সরকারের উদ্দেশ্য জনকল্যাণ নয়। তারা তাৎক্ষণিক আর্থিক লাভের দিকে বেশি মনোযোগী। উচ্চমাধ্যমিক পাস করা অনেক তরুণকে তাই উচ্চশিক্ষার লোভ দেখানো হয়। এতে সরকারের কয়েকটি লাভ।
এক. বহির্বিশ্বকে দেখানো যায় যে আমাদের বেকারত্ব নেই এবং দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী শিক্ষা, কর্ম বা প্রশিক্ষণের মাঝেই ব্যস্ত আছে। এতে কিছু সময়ও বিলম্ব করা যায়।
দুই. বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বিনা মূল্যে পড়ে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একদম অলাভজনক নয়। তিন. বিশ্ববিদ্যালয়ে যত বেশি শিক্ষার্থী, তত বেশি দলীয় কর্মী!
কিন্তু এগুলো সবই শুভংকরের ফাঁকি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাকরি বা কর্মসংস্থানের বাজারের সঙ্গে সম্পর্কহীন। চাকরিপ্রাপ্তির ন্যূনতম যোগ্যতা ও দক্ষতা উন্নয়নেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যর্থ। তাঁরা মনে করেন শিক্ষার্থীদের চাকরিপ্রাপ্তি তাদের মাথা ঘামানোর বিষয় নয়।
আরও ভয়ংকর তথ্য রয়েছে আমাদের দেশের যুবনীতিতে। একটি দেশের নীতিমালা অগ্রাধিকার দিচ্ছে তরুণদের বিদেশে প্রেরণ এবং তৈরি পোশাক খাতে কাজে লাগানোকে! শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা বা কর্মসংস্থানের বাস্তবিক উন্নয়ন তাদের উদ্বেগের জায়গা নয়! এতটা অবহেলা!
সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাই আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে! আমাদের প্রাপ্য জ্ঞান বা দক্ষতা কিছুই আমরা পাইনি। পেয়েছি অবহেলা, পেয়েছি দাসত্বের মানসিকতা, পেয়েছি বুলেট। তবে আজকের কিশোর-তরুণেরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল নয়। শেখার, উপার্জনের জন্য তাদের আছে নিজস্ব পথ।
এখন প্রশ্ন হলো, যা শেখা প্রয়োজন, তরুণেরা নিজেরাই যেহেতু তা শিখে ফেলছেন, তাহলে আমরা কি সব স্কুল-কলেজ তুলে দেব? সেটি মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বরং শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের মানুষের এবং তরুণদের কী আকাঙ্ক্ষা, সেটি গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে। গভীরভাবে দ্রুততার সঙ্গে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে যে বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা নিয়ে কোন দিকে যেতে চাইছে। সেদিকে যেতে আমাদের কী পরিবর্তন দরকার, তাতে কত বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, কীভাবে সেই মহাযজ্ঞ সমন্বয় করা সম্ভব।
আগে আমাদের ঠিক করতে হবে জাতীয় দর্শন। আর তা থেকেই বেরিয়ে আসবে আমাদের শিক্ষাদর্শন। এরপর দরকার একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন। এই কমিশন দায়িত্ব নিয়ে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং বাস্তবায়নযোগ্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে। এই শিক্ষানীতির সঙ্গে সমন্বয় থাকবে যুব, ক্রীড়া, কর্মসংস্থানসহ সব সংশ্লিষ্ট নীতির।
অনীহা হোক বা ইচ্ছাকৃত, বিগত সব সরকারই শিক্ষা নিয়ে প্রাথমিক পর্যায় থেকে আলোচনা শুরু করেছে এবং তা উচ্চশিক্ষার গন্তব্য নিরূপণে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বেকারত্ব আমাদের চিরসঙ্গী হয়ে গেছে। আমি প্রস্তাব করতে চাই, শিক্ষা এবং তার সংশ্লিষ্ট সব নীতি একবার টপ-ডাউন অর্থাৎ ওপর থেকে নিচেও পর্যালোচনা করা হোক।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বাংলাদেশের মানুষের অনেক আশা। তরুণদের উন্নয়নের জন্য সম্পূর্ণ ব্যবস্থা পুনর্নির্মাণ করা প্রয়োজন। আমরা আশা করছি যে শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করার জন্য নিবেদিত একটি কমিশন খুব দ্রুতই গঠিত হবে। এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সত্যিকারের গবেষণালয় হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এবং দেশের শিক্ষার সঠিক রূপায়ণের জন্য কাজ করবে।