বাংলাদেশের বর্তমান কোটা আন্দোলন আবারও জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে। তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা, কোটা পদ্ধতির সংস্কার এবং ন্যায্যতার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। ২০১৮ সালের আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি হয়ে ওঠা এই আন্দোলন সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণের পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে ঘোষণা দেন যে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হবে। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে এই ঘোষণা বাস্তবায়ন করে। কিন্তু সম্প্রতি হাইকোর্টের রায়ে এই পরিপত্র বাতিল হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আবারও আন্দোলনে নেমেছে। তাদের দাবি, মেধাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া বজায় রাখা এবং অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি বাতিল করা।
আন্দোলনকারীদের দাবি
আন্দোলনকারীরা চারটি প্রধান দাবি উত্থাপন করেছেন:
যৌক্তিকতা এবং বাস্তবতা
কোটা আন্দোলনকারীদের দাবি, বর্তমান কোটা পদ্ধতি মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং নাগরিকের সমান সুযোগের পরিপন্থী। কোটা আন্দোলনকারীরা যুক্তি দেন, বর্তমান কোটা পদ্ধতি বৈষম্য সৃষ্টি করছে এবং নাগরিকের সমান সুযোগের পরিপন্থী। ৫৬ শতাংশ কোটা প্রথা শিক্ষিত তরুণদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের মতে, শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি নয়, সকল গ্রেডেই কোটাব্যবস্থা সংস্কার করা উচিত। এই দাবির পিছনে কিছু যুক্তি ও বাস্তবতা রয়েছে, যা বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে:
যৌক্তিকতা:
বৈষম্যের অবসান: কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশ পদ সংরক্ষিত থাকায় মেধাবী প্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে যোগ্য প্রার্থীদের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে।
ন্যায়বিচারের প্রশ্ন: ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার পর কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছিল। হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়ে সেই পরিপত্র বাতিল হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে মনে করছেন। তাদের মতে, এই রায়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।
মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন: বর্তমান সময়ে প্রতিযোগিতামূলক চাকরি বাজারে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোটা পদ্ধতি বাতিল করে মেধাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
বাস্তবতা:
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন: কোটা পদ্ধতি সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছিল। তবে, এখন সময় এসেছে এই পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়ন করার। কোটার মাধ্যমে যারা আসলে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পায় না, তাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত।
কোটার অপব্যবহার: আন্দোলনকারীরা দাবি করেন যে, বর্তমানে কোটা সুবিধা কিছু বিশেষ শ্রেণির লোকের জন্য সংরক্ষিত হয়ে যাচ্ছে, যা সত্যিকার অর্থে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সহায়ক নয়। উদাহরণস্বরূপ, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতি বা তৃতীয় প্রজন্মের কোটা প্রথা অযৌক্তিক বলে মনে করেন আন্দোলনকারীরা।
একাধিকবার কোটা সুবিধার ব্যবহার: আন্দোলনকারীরা মনে করেন, একাধিকবার কোটা সুবিধা ব্যবহার করার সুযোগ থাকলে তা বৈষম্য সৃষ্টি করে। তাদের মতে, সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটাসুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে।
দুর্নীতি ও প্রশাসনের দক্ষতা: কোটা পদ্ধতির অপব্যবহার এবং দুর্নীতির মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
হাইকোর্টের রায় এবং সরকারী প্রতিক্রিয়া
হাইকোর্টের রায়ের ফলে শিক্ষার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে মনে করছেন আন্দোলনকারীরা। তারা প্রশ্ন তুলছেন, কেন ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করা হলো এবং এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হলো। সরকারী বিভাগের মধ্যে এই সমন্বয়হীনতার কারণে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ এবং বঞ্চিত বোধ করছেন।
আন্দোলনের প্রভাব
বর্তমান আন্দোলন দেশের তরুণ প্রজন্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মসংস্থানের অভাব এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এই সময়ে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা মেধাবী তরুণদের হতাশ করেছে। শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, তাদের আন্দোলন সরকারের নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলবে এবং একটি সমতা ভিত্তিক, মেধাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হবে।
অতএব, বর্তমান কোটা আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সমসাময়িক বিষয়। সকলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদেরকে যৌক্তিক এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে। মেধাভিত্তিক এবং সমতা ভিত্তিক সমাজ গঠনে সরকার এবং জনগণের যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।