টিলা পাড়ি দিতে হবে। সবাই ক্লান্ত বোধ করলেও অল্পের জন্য কেউই মনোবল হারাতে নারাজ। তাই ১০-১২ মিনিটের মধ্যে সামনের উঁচু–নিচু টিলা পাড়ি দিয়ে সবাই পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে। জায়গাটার নাম হজমটিলা। ঘড়ির কাঁটা তখন ছয়টা ছুঁই ছুঁই। তখনো কিন্তু সুয্যিমামা তার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছিল। মোটরসাইকেলগুলো এক পাশে রেখে তড়িঘড়ি যে যার মতো ছবি তোলা শুরু করে দিলাম। চারপাশের দৃশ্যটা নিজ চোখে না দেখলে আসলে লেখায় বোঝানো মুশকিল। এককথায়, যত দূর চোখ যাচ্ছিল শুধু সবুজ আর সবুজ। খুব কাছেই ভারত সীমান্ত। সন্ধ্যা নামার পর নাকি সীমান্তের ওপারের বাড়িঘরের ঝলমলে আলো স্পষ্ট দেখা যায়। জানতে পারলাম, সীমান্তের ওপারের এলাকার নাম ‘মনাইবাড়ি’। হরিণছড়া দিয়ে এলেও হজমটিলার এই জায়গা পার্শ্ববর্তী বিদ্যাবিল চা–বাগানের আওতাধীন। কেউ চাইলে এদিক দিয়ে না এসে রাজঘাট, বিদ্যাবিল হয়ে ঘুরেও হজমটিলায় আসতে পারবে। টিলার ওপর নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলেও এমনিতে এসব এলাকায় নেটওয়ার্ক পাওয়াটা সহজ নয়।
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে হজমটিলায় পৌঁছাতে আমাদের সময় লেগেছিল প্রায় দুই ঘণ্টা। বিকেল চারটায় রওনা দিয়ে সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ আমরা হজমটিলায় পৌঁছাতে পেরেছিলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা হজমটিলার প্রকৃতিতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে সুয্যিমামা বিদায় নিল। আমরাও হজমটিলাকে বিদায় জানালাম। ঘড়িতে তখন ৬টা ৩৭ মিনিট।
একে একে টিলা পাড়ি দিয়ে এবার নিচে নামার পালা। ওঠার চেয়ে নামাটা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সাবধানে প্রথমে মোটরসাইকেল চালিয়ে নামানো হলো। তারপর একে একে আমরা। টিলার নিচে নামতেই চা–বাগানের ঝিঁঝিপোকার ডাক
শুনতে পেলাম। চা–বাগানের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় চোখে পড়ল, মাঠ থেকে গরুর পাল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন রাখালেরা। রান্নার জন্য লাকড়ি ও গরুর জন্য ঘাস নিয়ে ফিরছেন দিনমজুর। মাঠে খেলছেন একদল তরুণ।
মাঠ পেরিয়ে চা–বাগানের বসতি এলাকায় ঢুকতে ঢুকতে বাড়ি বাড়ি বৈদ্যুতিক বাতির আলো জ্বলে উঠল। হারিকেন বা কুপিবাতির আলো এখন এ রকম সীমান্ত এলাকার জন্যও অতীত হয়ে গেছে। হরিণছড়া এলাকাটি পার হতে অন্ধকার আমাদের ঘিরে ধরল। আমাদের প্রতিটি মোটরসাইকেলের হেডলাইট জ্বালিয়ে রাখতে হলো। পথেই সিদ্ধান্ত হলো, কেজুরীছড়া দুর্গামন্দিরের পাশে বিশ্বজিতের দোকানে ডালপুরি, পেঁয়াজু খাওয়া হবে। বিশ্বজিতের দোকানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাতটার বেশি বেজে গেল। পাশের টিউবওয়েলে সবাই হাত–মুখ ধুয়ে ঠান্ডা পানি খেয়ে চেয়ারে বসতে না বসতেই গরম গরম ডালপুরি, পেঁয়াজু হাজির। ভেজে আনতে না আনতে সাবাড় হয়ে যাচ্ছে। এ রকম চলল চার–পাঁচ রাউন্ড। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আটটার দিকে আবার যাত্রা শুরু করা গেল। চারপাশে বিভিন্ন যানবাহন হেডলাইট জ্বালিয়ে আসছে–যাচ্ছে। আমরাও থেমে নেই। একে একে কেজুরীছড়া, ফুসকুড়ি, জানাউড়া, কালীঘাট, ফুলছড়া হয়ে রামনগর এসে থামলাম। এবার যে যার মতো করে নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশে রওনা হব।
যাতায়াত ও খরচ: শ্রীমঙ্গল শহরের কালীঘাট রোড পয়েন্টে গেলে হরিণছড়া চা–বাগানগামী অনেক সিএনজি পাবেন। হরিণছড়া ধুপঘর পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া ৬০ টাকা। হরিণছড়ার মাঠ পেরিয়ে হজমটিলার রাস্তার মুখ পর্যন্ত গেলে ৭০ টাকা। সিএনজি রিজার্ভ নিলে ৩০০ টাকা। বেশি মানুষ হলে জিপগাড়ি ভাড়া নিয়ে নিতে পারেন। সারা দিন চুক্তিতে গেলে তারা ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা বললেও এসব জায়গার জন্য নিলে কথা বলে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায় মানাতে পারবেন। তাঁদের হরিণছড়া মাঠ পেরিয়ে হজমটিলায় যাওয়ার প্রবেশমুখে নামিয়ে দিতে বলবেন।
যা যা দেখে আসতে পারেন: শ্রীমঙ্গল থেকে হজমটিলার উদ্দেশে সকাল সকাল রওনা দিয়ে দিতে পারলে একসঙ্গে কয়েকটি জায়গা ঘুরে আসতে পারবেন। হরিণছড়ায় ঢোকার আগে কেজুরীছড়ায় ডিনস্টন সিমেট্রি দেখে যেতে সব মিলিয়ে বড়জোর ২০-২৫ মিনিট লাগবে। তারপর হজমটিলার উদ্দেশে হরিণছড়া হয়ে যাওয়ার সময় জপমালা রানী মা মারিয়ার তীর্থস্থানটি দেখে যেতে পারেন। বের হয়ে হরিণছড়া খেলার মাঠের বাঁ পাশের রাস্তা দিয়ে ঝাউবনটা দেখে বের হতে পারেন। তারপর সোজা রাস্তা ধরে হজমটিলায় চলে যেতে পারেন।