Search
Close this search box.

বুধবার- ৩০শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অনলাইনে স্বাস্থ্যপণ্যের ভুয়া প্রচার, নেপথ্যে আন্তর্জাতিক চক্র

অনলাইনে স্বাস্থ্যপণ্যের ভুয়া প্রচার, নেপথ্যে আন্তর্জাতিক চক্র

দৃষ্টিশক্তি ফেরাবে, ব্যথা সারাবে বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখবে—এমন ‘ওষুধের’ প্রচারণা চলছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওয়েবসাইটে। দেশ–বিদেশের নামকরা ব্যক্তিদের ছবি, সাক্ষাৎকার (ভুয়া) রয়েছে তাতে। গ্রাহকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করতে দেশি–বিদেশি গণমাধ্যমের লোগো, নাম ও ওয়েবসাইট নকল করে এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে চালানো হচ্ছে প্রচারণা। বাংলাদেশসহ অন্তত ১৫টি দেশে সক্রিয় একটি চক্র এভাবে স্বাস্থ্যপণ্য বিক্রির চেষ্টা করছে।

গত এক মাসে নতুন করে গতি পেয়েছে এ প্রচারণা। এর মাধ্যমে যেসব ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে, সেগুলোর কোনোটি চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ নয়। কোনোটি ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট (খাদ্য সম্পূরক) ও কোনোটি সাধারণ মলম।

ফেসবুকে স্বাস্থ্যপণ্যের এমন প্রচারণার একটিতে ব্যবহার করা হয়েছে বাংলাদেশের অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহার ছবি ও ভুয়া সাক্ষাৎকার। ‘অপ্টিম্যাক্স’ নামের একটি ওষুধ বিক্রির এ প্রচারণার ঘটনায় ১ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তিনি। প্রথম আলোর ওয়েবসাইটের নকল ও লোগোও ব্যবহার করা হয়েছে এ ভুয়া প্রচারে।

গত এক মাসে নতুন করে গতি পেয়েছে এমন প্রচারণা। এর মাধ্যমে যেসব স্বাস্থ্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছে, সেগুলোর কোনোটি চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ নয়। কোনোটি ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট (খাদ্য সম্পূরক) ও কোনোটি সাধারণ মলম।
এ বিষয়ে ৩ জুলাই প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সে সময় সেঁজুতি সাহা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘এই পণ্য সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই। বানিয়ে বানিয়ে একটি সাক্ষাৎকার তৈরি করা হয়েছে। পদবিও ভুল। আমি ডাক্তার না। চোখ নিয়েও কখনো কাজ করিনি। এসবের প্রচারণায় আমার অনুমতিও নেওয়া হয়নি। এখানে আমার, মুন্নী সাহা (সাংবাদিক) এবং প্রথম আলোর পরিচয় ব্যবহার করা হয়েছে। মানুষ এই নাম–পরিচয় দেখে সহজেই বিশ্বাস করে ফেলতে পারে এবং তাদের ক্ষতি হতে পারে। এটা ভয়ংকর।’

বাংলাদেশে সেঁজুতি সাহা ছাড়াও আরও দুজন চিকিৎসকের ছবি দিয়ে অপ্টিম্যাক্সের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এতে ব্যবহার করা হচ্ছে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ছবিও।

নিউজ পোর্টালের নকল, ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য–ছবি, মিথ্যা পরিচয়

প্রচারণার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা বেশির ভাগ ওয়েবসাইট নিউজ পোর্টালের আদলে করা। মূলধারার নিউজ পোর্টালের মতোই তাদের একই রকম মেন্যুবার থাকে। এ ছাড়া সব কটিতে বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যম বা কল্পিত নাম ব্যবহার করা হয়। ওয়েবপেজগুলোর নকশা কমবেশি একই রকম। প্রতিটিতে শেষ দিকে পণ্যের বিবরণ ও কেনার উপায় বলা থাকে। প্রতিটি দেশের জন্য স্থানীয় মুদ্রায় পণ্যের দাম উল্লেখ থাকে এবং ওয়েবসাইটে পণ্য অর্ডার করার জন্য আলাদা কান্ট্রিকোডসহ ফর্ম বা একটি বাটন থাকে; যার মাধ্যমে বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।

তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ‘ডিজিটালি রাইট’-এর তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ‘ডিসমিসল্যাব’ দেখেছে, পণ্য, দেশ ও ডোমেইন আলাদা হওয়ার পরও পেজগুলোতে যোগাযোগের যে ফর্ম বা বাটন দেওয়া হয়েছে, তা একই রকমের। আবার যেসব গণমাধ্যমের পরিচয় ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো নকল, সাক্ষাৎকার ভুয়া এবং তাতে বিশেষজ্ঞদের বিবরণও মিথ্যা। এমনকি বিজ্ঞাপনের ছবি ও বার্তাও ভুয়া।

ডিসমিসল্যাব অপ্টিম্যাক্স নামের ওষুধের প্রচারণা ধরে এর নেপথ্যে থাকা চক্রকে খোঁজার চেষ্টা করেছে। এ নিয়ে আজ বুধবার তাদের প্রকাশ করা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে একটি ওষুধ বা স্বাস্থ্যপণ্য প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপন দিতে বেশ কিছু পেজ খোলা হয়। বিজ্ঞাপনে ক্লিক করলে বা পণ্যটি কেনার আগ্রহ দেখিয়ে মেসেজ পাঠালে বা মন্তব্য করলে একটি ওয়েবসাইটের লিংক দেওয়া হয়। সেই লিংকে নামী-বেনামি গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটের আদলে দেখা যায় একটি ওয়েবপেজ। কোনো বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকের সাক্ষাৎকার থাকে সেখানে। সাক্ষাৎকারে একটি অসুখ থেকে দ্রুত মুক্তির জন্য একটি ওষুধের নাম বলা হয় এবং শেষে ওষুধটি কিনতে যোগাযোগের ব্যবস্থার উল্লেখ থাকে।

বাংলাদেশে অপ্টিম্যাক্স বিক্রির আরও দুটি ওয়েবপেজের সন্ধান পেয়েছে ডিসমিসল্যাব। সেখানেও একইভাবে বিশেষজ্ঞদের ছবি দিয়ে ভুয়া সাক্ষাৎকার প্রচার করা হচ্ছে। মূলত তিনটি ওয়েব ডোমেইন ও সাব-ডোমেইনের মাধ্যমে দেশে এ প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এগুলো প্রথম আলো ও বিবিসির ওয়েবসাইটের নকশা নকল করে বানানো হয়েছে। ফেসবুক ছাড়াও ইউটিউবে চালানো হচ্ছে অপ্টিম্যাক্সের প্রচারণা।

ডিসমিসল্যাব নির্দিষ্ট ফরম থেকে অপ্টিম্যাক্সের ফরমাশ দেয়। এরপর একটি নম্বর থেকে যোগাযোগ করা হয়। টেলিফোনে অর্ডার করার পর ‘ট্রাস্ট ফার্মেসি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে অপ্টিম্যাক্সের কৌটা পাঠানো হয়।

কৌটাটির গায়ে লেখা, প্রস্তুতকারক ম্যাক্সহার্ব লিমিটেড। কৌটাতেই প্রতিষ্ঠানটির দুটি ঠিকানা দেওয়া। একটি জার্মানির ও অপরটি সিঙ্গাপুরের। দুটি ঠিকানাই শেয়ার্ড অফিস স্পেসের অর্থাৎ যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চাইলে ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেখান থেকে জায়গা ভাড়া নিতে পারে।

আন্তর্জাতিক চক্র
ডিসমিসল্যাব তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে এ ধরনের প্রচারণা চলছে বৈশ্বিক পর্যায়ে এবং তা বহুবিধ স্বাস্থ্যপণ্য নিয়ে। ইতালি, পোল্যান্ড, সার্বিয়া, ফিলিপাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাংলাদেশসহ ইউরোপ ও এশিয়ার অন্তত ১৫টি দেশে এ ভুয়া প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ডিসমিসল্যাব এখন পর্যন্ত এ প্রচারণার প্রথম উৎস পেয়েছে রাশিয়ায়—২০২০ সালে। ওই বছরের আগস্ট মাসে স্থানীয় সামাজিক যোগযোগমাধ্যম ভিকে বা ভি-কন্টাক্টে এ–সংক্রান্ত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। এরপর এটি পূর্ব ইউরোপ ও বলকান অঞ্চল এবং এরপর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়াতে দেখা যায়।

বাংলা, ইংরেজি, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, সার্বিয়ান, বুলগেরিয়ান, বসনিয়ান-ক্রোয়াট, তুর্কিসহ কমপক্ষে ১২টি ভাষা ব্যবহার করে প্রচারণা চলছে। একেক দেশে একেক গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট নকল করা হয়েছে।

বাংলাদেশে অপ্টিম্যাক্সের প্রচার চালানো একটি ওয়েবসাইটের মূল ডোমেইন ছিল ওয়াওটপ ডট শপ। এই ডোমেইনের অধীন দুটি আলাদা ওয়েবসাইট খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। সেখান থেকে মূলত ইংরেজি ভাষায় ফিলিপাইন ও আরব আমিরাতে ডায়াবেটিসের তথাকথিত ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে।

যেসব স্বাস্থ্যপণ্য বিক্রিতে প্রচারণা
ডিসমিসল্যাব প্রচারণায় ব্যবহৃত ১১টি ওয়েবসাইটে ছয়টি স্বাস্থ্যপণ্যের বিজ্ঞাপন পেয়েছে। এগুলো মূলত ফুড সাপ্লিমেন্ট ও মলম।

এ ছাড়া ফিলিপাইন, আরব আমিরাত ও ইতালিতে ডায়াবেটিন, ডায়াবেক্সটান এবং ডায়াস্টাইন নামের তিনটি পণ্যের প্রচারণা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে ডায়াবেক্সটান গ্রহণ না করার জন্য ফিলিপাইনের ওষুধ প্রশাসন গ্রাহকদের সতর্ক করেছে। পোলিশ ভাষার একটি ওয়েবসাইটে অস্থিসন্ধির ব্যথা নিরাময় ‘ফ্লেক্সিও’ নামের একটি ক্রিম বিক্রি হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অথরিটির (এফডিএ) মতে, ওষুধ ও সাপ্লিমেন্ট এক নয়। তবে সাপ্লিমেন্টে অনেক সময় ওষুধের ব্যবহার থাকতে পারে বলে এটি গ্রহণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলে এফডিএ।

প্রচারণায় ফেসবুকের ব্যবহার
প্রচারণায় ওয়েবসাইটের পাশাপাশি ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশে অপ্টিম্যাক্স পণ্য বিক্রির অন্তত ১৭টি ফেসবুক পেজের সন্ধান পেয়েছে ডিসমিসল্যাব। এর মধ্যে পাঁচটি বিজ্ঞাপনও চালাচ্ছে।

মেটার বিজ্ঞাপন নীতিমালায় বলা আছে, বিজ্ঞাপনে অতিরঞ্জিত দাবি এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিদের ব্যবহার করে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে পরিচালিত ও জুনের প্রথম সপ্তাহে পাওয়া ৩০টি সক্রিয় ফেসবুক বিজ্ঞাপনের বেশির ভাগেই সেঁজুতি সাহার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে; যেগুলোতে মিথ্যা তথ্য রয়েছে।

এ বিষয়ে ডিসমিসল্যাবের প্রধান গবেষক মিনহাজ আমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা একটি বৈশ্বিক চক্র। সবার প্রচারণা একই রকম। ফেসবুক, ইউটিউবের মতো জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে এবং পয়সা দিয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। বিজ্ঞাপনগুলো এখনো সচল। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মগুলোর এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে যে নীতিমালা রয়েছে, তা এখানে প্রযোজ্য হচ্ছে না। এ ছাড়া পোস্টগুলো অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে। যেহেতু স্বাস্থ্যপণ্য, তাই বিষয়টি খুব সংবেদনশীল।’

আরও পড়ুন

সম্পর্কিত আরো খবর

জনপ্রিয়