Search
Close this search box.

বুধবার- ৩০শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

জাহাঙ্গীরনগরে কেটেছে আতঙ্ক; বদলে গেছে হল, গেস্টরুম, ক্যানটিনের চিত্র

জাহাঙ্গীরনগরে কেটেছে আতঙ্ক; বদলে গেছে হল, গেস্টরুম, ক্যানটিনের চিত্র

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের অতিথিকক্ষটি (গেস্টরুম) পরিপাটি করে সাজানো। একদিকে দুই শিক্ষার্থী একাডেমিক পড়ালেখায় ব্যস্ত, অন্যদিকে সোফায় বসে পাঁচ শিক্ষার্থী কী নিয়ে যেন আলাপ করছিলেন। কথা বলে জানা গেল, তাঁরা ‘গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট’ করছেন। দক্ষিণ দিকের নতুন যে সোফা, সেখানে বসে খোশগল্পে মেতে ছিল পাঁচ থেকে ছয়জনের একটি দল। সবার মুখে হাসি।

১১ সেপ্টেম্বরের দৃশ্য এটি। গেস্টরুমে খোশগল্পে মেতে থাকা দলটির সঙ্গে যোগ দিই। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. রহমাতুল্লাহ বলেন, ‘মনের আনন্দে আড্ডা দিচ্ছি, তাই মন খুলে হাসছি। ম্যানার শেখার ভয় নাই।’

শিক্ষার্থীরা জানান, মাস দুয়েক আগে এই ‘গেস্টরুম’ সাধারণ শিক্ষার্থী, বিশেষত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে ছিল এক আতঙ্কের নাম। রাত হলেই জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে ‘ম্যানার’ শেখানোর নামে চলত অমানুষিক নির্যাতন। পান থেকে চুন খসলেই শুরু হতো গালিগালাজ, হট্টগোল। নামে গেস্টরুম হলেও ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের ‘আড্ডাস্থল’ হিসেবেই ছিল পরিচিতি। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনসংকটও কেটে গেছে বলে দাবি করলেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের ভাষ্য, নামে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও জাহাঙ্গীরনগরে গত কয়েক বছর ছিল তীব্র আবাসনসংকট। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ঠাঁই হতো গণরুমে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুতেই ‘গণরুম সংস্কৃতিতে’ পড়ে অনেক শিক্ষার্থীই আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলতেন।

হলগুলোয় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেতা-কর্মীদের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে কৃত্রিম আবাসনসংকট ছিল প্রবল। কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর চিত্রপট পাল্টেছে। ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাসে একধরনের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন শিক্ষার্থীরা। বেশির ভাগ হল গণরুম-মিনিগণরুমমুক্ত হয়েছে। কোনো কোনো হলে ‘রাজনীতিমুক্ত হল’ ব্যানার টানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এখন নেই র‍্যাগিং বা গেস্টরুম সংস্কৃতি।

হাওয়াবদল

বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে থাকতেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান। নিজে অছাত্র হলেও এই হলের একাত্তর ব্লকের তিনতলায় চার আসনের দুটি কক্ষে তিনি একাই থাকতেন। শুধু হাবিবুর নন; ওই হলে অন্তত ৩০টি কক্ষ অছাত্ররা দখল করে রেখেছিলেন। বেশির ভাগ কক্ষেই নেতারা একা থাকতেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আরাম-আয়েশে থাকলেও একটি সিটের আশায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৃতীয় বর্ষ পেরিয়ে গেলেও একটি সিট জুটত না। বাধ্য হয়ে অনেকে বাইরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। সেই চিত্রও এখন পাল্টেছে। যে হলে শিক্ষার্থীরা আসন না পেয়ে বাইরে থাকতেন, গণরুমে থাকতেন, সেই হলে সব শিক্ষার্থীকে তাঁর ন্যায্য আসন বুঝিয়ে দেওয়ার পরও অন্তত ১০০টি আসন ফাঁকা রয়েছে।

শুধু বঙ্গবন্ধু হল নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব হলেই একই রকম চিত্র চোখে পড়ল। মওলানা ভাসানী হলের তিনতলায় থাকতেন ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল। চারজনের কক্ষে তিনি একাই থাকতেন। টিভি, ফ্রিজ, আয়েশি বিছানা, কী ছিল না তাঁর ঘরে! ওই হলেও অন্তত ২৫টি ঘর নেতা-কর্মীরা দখল করে রেখেছিলেন। আর সাধারণ শিক্ষার্থীরা আসন না পেয়ে ৪ জনের ঘরে ১০ থেকে ১২ জন থাকতেন। শিক্ষার্থী ও হল প্রশাসনের উদ্যোগে এখন আসন বণ্টন হয়েছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ‘ম্যানার শেখানোর’ নামে পোশাক পরিধানে নিয়ম বেঁধে দিতেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। জিনস প্যান্ট ও ফুলহাতা শার্ট পরে চলাফেরা করতে হতো। এমনকি হলের ভেতরের খাবারের দোকানগুলোয় খাওয়ার ‘অনুমতি’ও জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ছিল না। এখন তাঁরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছেন। প্রথম বর্ষের আবাসিক ছাত্র তারেক মুহাজির বলেন, ‘আগে হলের ওয়াশরুমে যেতে হলেও জিনস প্যান্ট আর ফুলহাতা শার্ট পরে যেতে হতো। অন্য পোশাকে দেখলেই ছাত্রলীগের ভাইয়েরা শাস্তি দিতেন। এখন আর সেই সমস্যা নেই।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরাদ চত্ত্বর এলাকায় আড্ডা দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরাদ চত্ত্বর এলাকায় আড্ডা দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরাছবি: প্রথম আলো

জনমবাকি, নাকি জনমফাঁকি?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হলের ক্যানটিনে নির্দিষ্ট একটা টেবিল ছিল, যেখানে লেখা থাকত—ছাত্রলীগের জন্য বরাদ্দ। সেই টেবিলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বসতে পারতেন না। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী হলের ক্যানটিনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে খাবার খেতেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সেই একই খাবার খেতেন না। হলের ক্যানটিনে তাঁদের জন্য আলাদাভাবে ভালো মানের খাবার রান্না করা হতো। এখন সেই অবস্থা আর নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে ক্যানটিন ও নাশতার দোকান আছে। এর বাইরে হল এলাকায় শতাধিক দোকানপাট আছে। সব কটি থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মাসিক হারে চাঁদা তুলতেন। ‘ফাও’ খেতেন। ‘জনমবাকি’ শব্দটির প্রচলনও তাঁদের জন্যই; অর্থাৎ আজীবনের জন্য তাঁরা বাকিতে খাবেন—এটাই ছিল অলিখিত নিয়ম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বকেয়া বিল চাইলে আবাসিক হলের কক্ষে নিয়ে করা হতো নির্যাতন। তবে এখন আর সেই চিত্র নেই। দোকানদারদের এখন মাসিক চাঁদা দেওয়া লাগে না। ‘জনমবাকি’র চলও নেই।

আরও পড়ুন

সম্পর্কিত আরো খবর

জনপ্রিয়