Search
Close this search box.

বুধবার- ৩০শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত: ঐতিহাসিক পটভূমি

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত একটি জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা যা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সংঘাতময় ইস্যু হিসেবে পরিচিত। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকে শুরু হয়ে আধুনিক যুগে গিয়ে স্থিতিশীল হয়। এই সংঘাতের মূল কারণ ভূখণ্ড এবং জাতিগত স্বায়ত্তশাসনের দাবী। এখানে এই সংঘাতের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইতিহাস এবং পটভূমি তুলে ধরা হলো।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত: ঐতিহাসিক পটভূমি

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত একটি জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা যা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সংঘাতময় ইস্যু হিসেবে পরিচিত। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকে শুরু হয়ে আধুনিক যুগে গিয়ে স্থিতিশীল হয়। এই সংঘাতের মূল কারণ ভূখণ্ড এবং জাতিগত স্বায়ত্তশাসনের দাবী। এখানে এই সংঘাতের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইতিহাস এবং পটভূমি তুলে ধরা হলো।

প্রাচীন ইতিহাস

ফিলিস্তিন অঞ্চলটি হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার কেন্দ্র। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলে কনানাইট, ইসরায়েলাইট, ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। ফিলিস্তিন মুসলিম এবং ইহুদীদের কাছে ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, এবং সাংস্কৃতিক কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে উভয় সম্প্রদায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হলো:

মুসলমানদের জন্য ফিলিস্তিনের গুরুত্ব

১. ধর্মীয় পবিত্রতা

মসজিদ আল-আকসা: মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, নবী মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে আল-আকসা মসজিদে গমন করেন এবং সেখান থেকে মিরাজে (স্বর্গে) আরোহণ করেন। এই ঘটনা ইসলামে “ইসরা ও মিরাজ” নামে পরিচিত।

বাইতুল মুকাদ্দাস: ইসলামিক ইতিহাসে প্রথম কিবলা ছিল জেরুজালেমের এই স্থানটি। পরবর্তীতে কিবলা মক্কার কাবা শরীফের দিকে পরিবর্তিত হলেও, এই স্থানটি এখনও পবিত্র।

২. নবীদের সংযোগ

ফিলিস্তিনের মাটি বহু নবীর জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে হযরত ইবরাহিম (আ.), হযরত দাউদ (আ.), হযরত সোলায়মান (আ.), হযরত মুসা (আ.), এবং হযরত ঈসা (আ.) সহ বহু নবীর জীবনের ঘটনা ঘটেছে।

৩. ঐতিহাসিক গুরুত্ব

খলিফা উমর ইবনে আল-খাত্তাব (রা.) এর সময়ে জেরুজালেম মুসলমানদের অধীনে আসে এবং মুসলিম সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়। এই বিজয় মুসলিম ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

ইহুদীদের জন্য ফিলিস্তিনের গুরুত্ব

১. ধর্মীয় পবিত্রতা

টেম্পল মাউন্ট (হার হাবায়িত): ইহুদীদের জন্য পবিত্রতম স্থান। এখানে প্রাচীন কালে প্রথম এবং দ্বিতীয় ইহুদি মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। ইহুদীদের বিশ্বাস অনুযায়ী, এখানেই আবরাহামের (ইব্রাহিম) সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে কৃতজ্ঞতার স্থান ছিল এবং মসিহ (মেসিয়াহ) এখানে আসবেন।

ওয়েস্টার্ন ওয়াল (কোটেল): দ্বিতীয় মন্দিরের শেষ অবশিষ্টাংশ এবং এটি ইহুদিদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত।

২. ঐতিহাসিক সংযোগ

ফিলিস্তিন ইহুদী ধর্মের প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে উল্লেখিত বহু ঐতিহাসিক ঘটনার স্থান। হিব্রু বাইবেলে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে এই ভূমি জড়িত।

প্রাচীন ইসরায়েল এবং যিহূদা রাজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ফিলিস্তিনের ভূমি ইহুদীদের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

৩. আধুনিক ইসরায়েল রাষ্ট্র

ইহুদী জনগণের জন্য ফিলিস্তিন হল তাদের জাতীয় জন্মভূমি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইহুদীরা এখানে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করেন। এটি তাদের জন্য একটি নিরাপদ আবাসস্থল এবং জাতীয় অস্তিত্বের প্রতীক।

ইসলামিক খিলাফত ও ক্রুসেড

৭ম শতাব্দীতে ইসলামের উদয় ঘটে এবং খলিফা উমরের শাসনামলে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা ফিলিস্তিন দখল করে। ক্রুসেড যুদ্ধগুলোতে ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা এই অঞ্চল পুনরায় দখল করতে চাইলেও সফল হয়নি। পরে, মমলুক ও অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে এই অঞ্চলটি মুসলিম শাসনের অধীনে থাকে।

অটোমান সাম্রাজ্য

১৫১৭ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। এই সময়ে ফিলিস্তিনে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করত।

আধুনিক ইতিহাস ও জায়নিস্ট আন্দোলন

১৯শ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপে জায়নিস্ট আন্দোলন শুরু হয়, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। দ্যোডোর হার্টজেল এই আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন। ফিলিস্তিনে ইহুদিদের বসতি স্থাপন ও ভূমি কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

বেলফোর ঘোষণা ও ব্রিটিশ শাসন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণা জারি করে, যেখানে ইহুদি জাতীয় বাড়ির প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ১৯২০ সালে সান রেমো সম্মেলনে ফিলিস্তিন ব্রিটিশ ম্যান্ডেট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইহুদি-আরব সংঘাত

১৯৩৬-১৯৩৯ সালের আরব বিদ্রোহ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে সংঘাত তীব্রতর হয়। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়: একটি ইহুদি রাষ্ট্র ও একটি আরব রাষ্ট্র। এই প্রস্তাব আরবরা গ্রহণ না করলেও ইহুদিরা গ্রহণ করে।

জাতিসংঘের প্রস্তাব এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি প্রস্তাবনা পাস করে যা ফিলিস্তিনকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত করার কথা বলে – একটি ইহুদি রাষ্ট্র এবং একটি আরব রাষ্ট্র। ইহুদিরা এই প্রস্তাব মেনে নেয়, কিন্তু আরবরা তা প্রত্যাখ্যান করে।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ

১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সমাপ্তির পর ইসরায়েল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। এতে আরব রাষ্ট্রগুলো আক্রমণ চালায়, যা প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে ইসরায়েল জয়ী হয় এবং ফিলিস্তিনের অনেক ভূমি দখল করে।

পরবর্তী সংঘাত ও শান্তি প্রচেষ্টা

১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা ও গোলান মালভূমি দখল করে। এই অঞ্চলগুলোর অধিকারের প্রশ্নে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা (পিএলও) এবং অন্যান্য সংগঠনগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে কিছু শান্তি প্রচেষ্টা করা হলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান এখনো হয়নি।

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি

গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘাত ছাড়াও মানবিক সংকট, অর্থনৈতিক সমস্যা ও সামাজিক বিভাজন এ অঞ্চলে বিরাজমান।

ফিলিস্তিনের ভূমি উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র। মুসলমানদের জন্য এটি তাদের ধর্মীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং পবিত্র স্থান। ইহুদীদের জন্য এটি তাদের প্রাচীন ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র। এই দ্বৈত পবিত্রতা এবং ইতিহাসের কারণে ফিলিস্তিন ইস্যু অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং জটিল। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের ঐতিহাসিক পটভূমি অনেক পুরনো ও জটিল। এই সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টা চলমান, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সমাধান এখনও অধরা।

দর্শক২৪ আন্তর্জাতিক সংবাদ পড়ুন

আরও পড়ুন

সম্পর্কিত আরো খবর

জনপ্রিয়